বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১০ মাঘ ১৪৩১

নৈতিকতার ভিত্তি বিনির্মাণে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভূমিকা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ

প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১১:৩৫ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১১:৩৭ পূর্বাহ্ণ
নৈতিকতার ভিত্তি বিনির্মাণে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভূমিকা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ

জাহানারা পারভীন লাকী

 

কবি শাহ মুহম্মদ সগীর বলেছেন, ‘ওস্তাদে প্রণাম করো পিতা হন্তে বাড়, দোসর জনম দিলো তিহ সে আহ্মার।’

পিতা-মাতা সন্তানকে জন্ম দেন সত্যি, কিন্তু সন্তানকে প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে তোলেন শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ। তাই কবি সগীর শিক্ষক-শিক্ষিকগণকে দোসর জনমদাতা বলেছেন। সন্তানের এই সফল জীবনগঠনে এবং নীতি ও নৈতিকতার কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নে মা-বাবার স্বপ্নপূরণকারী হিসেবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রশ্ন আসতে পারে – পৃথিবীতে এতো বিদ্যালয় থাকতে সন্তানের সফল জীবন গঠনে এবং নৈতিকতার কাঙ্ক্ষিত বিকাশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন? এর প্রথম উত্তর হলো ,এ বিদ্যালয় হলো সন্তানের শৈশবের বিদ্যালয়। মানব সন্তানের ভবিষ্যৎ জীবনের বুনিয়াদ বা ভিত্তি স্থাপিত হয় এই শৈশব বা বাল্যজীবনেই। তখন ওদের হৃদয়টা থাকে নরম কাদার মতো। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ যে ধাঁচেই তাদেরকে গড়ে তুলবে, ঠিক সে ধাঁচেই তাদের চিন্তা, চেতনা, মেধা ও চরিত্র বিকশিত হবে। পরবর্তী সকল বিদ্যালয়ে কেবল এই ভিত্তিটাকে ফুলে-ফলে সুশোভিত করা হয়। তাই বলা যায়, পিতা-মাতার পক্ষ থেকে তাঁদের ঐকান্তিক সহযোগী হিসেবে সন্তানের শৈশবটাকে সফল ও উন্নত জীবনের ভিত্তি হিসেবে গড়ে তোলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিবেদিত প্রাণ শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ।

সন্তানের জীবনটাকে সফল ও সার্থক করতে হলে শিক্ষক-শিক্ষিকাগণকে যে সব বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হয় সেগুলো হলো তাদের মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতা ও প্রতিভার বিকাশ, ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ, সময়ানুবর্তিতা, শিষ্ঠাচার, সামাজিকতা ও দেশপ্রেম, দায়িত্ববোধ ও কর্তব্য পরায়ণতা এবং শৃঙ্খলা। এসমস্ত গুণ ও যোগ্যতা যদি কোনো মানব সন্তানের শৈশবে গড়ে না ওঠে, তাহলে পরবর্তী বিদ্যালয়সমূহে তাকে সুপথে পরিচালিত করা ও যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। প্রবাদ আছে ,’কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশপাকলে করে ঠাস ঠাস।’ তাই মানব সন্তানকে সত্যিকার মানব সন্তান হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে
সফল ও মহৎ জীবনের ভিত্তি নির্মাতা হিসেবে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

আমরা জানি, শৃঙ্খলাই হলো শৃঙ্খলমুক্তির একমাত্র পথ এবং চরিত্র মানব জীবনের অমূল্য সম্পদ। যার জীবনে শৃঙ্খলা নেই, তার জীবনে কখনো কাঙ্ক্ষিত সফলতা আসেনা। চরিত্র মানব জীবনের মুকুট স্বরূপ। যার চরিত্র নেই, তার কোনো যোগ্যতাই নেই। তাই শৃঙ্খলার অভ্যাস যেমন শৈশব থেকে গড়ে তুলতে হবে, তেমনি শৈশব থেকেই সন্তানের উত্তম চরিত্র গঠন করতে হবে। দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য, তাই সন্তানের শ্রেণি ও বয়স উপযোগী লেখাপড়ার পাশাপাশি তাদের সচ্চরিত্র গঠন করতে হবে। বড়োকে সম্মান ও ছোটকে স্নেহ করার শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। তাকে এভাবে গড়ে তুলতে হবে যেন সে পিতা-মাতা ও শিক্ষক-শিক্ষিকা কে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে এবং সকলের সাথে সুন্দর ব্যবহার করে। আদব-কায়দা তথা আচরণিক মূল্যবোধের অভাবে যেকোনো মানব সন্তান চরম ব্যর্থতার শিকারে পরিণত হবে ।

ইতিহাসের বিখ্যাত মনীষীগণের সফল জীবন বিনির্মাণে নৈতিক শিক্ষা বিশাল ও অনন্য অবদান রেখেছিল। শৈশবে যে নৈতিকতার বাণী তাঁরা আত্মস্থ করেছিলেন তা তাঁদের মনে অসাধারণ নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করেছিল। এই নীতিবোধের ফলে তাঁরা প্রকৃত মানুষ রূপে গড়ে উঠতে পেরেছিলেন। তাই নিঃসন্দেহে মানব সন্তানের নৈতিকতা শিক্ষায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এটা সর্বজন বিদিত যে শিক্ষক-শিক্ষিকাগণের ভালো কথা, উপদেশ ও পরামর্শ শিক্ষার্থীদের মনে সুগভীর প্রভাব বিস্তার করে । শিক্ষকদের ভালো কথায় প্রবল অনুপ্রাণিত হওয়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা তাঁদের কথা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে। তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষার ব্যাপারে বিভিন্নভাবে প্রয়াস চালাতে পারেন এবং শ্রেণিতে পাঠদানের পাশাপাশি নৈতিকতা শিক্ষার ব্যাপারে আলোকপাত করতে পারেন। প্রতিদিন পাঠদানের শুরুতে বা শেষে নৈতিকতা চর্চার ব্যাপারে উপদেশ দিতে পারেন। নীতিকথা নিয়ে অনেক গল্প আছে, তাঁরা শিক্ষার্থীদেরকে সেগুলো শোনাতে পারেন। শিক্ষার্থীরা এসব গল্পে উজ্জীবিত হতে পারে এবং নীতিকথাগুলো তাদের মনের গভীরে শিকড় গাড়তে পারে। দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদেরকে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করে গড়ে তুলতে হবে। সদা সত্য কথা বলার অভ্যাস তৈরি করতে হবে। প্রত্যেক ধর্মেই ভালো ভালো বাণী রয়েছে। এই বাণী বা সদুপদেশগুলো ক্লাসে বেশি বেশি আলোচনা করতে হবে। ভালো কাজ করা, মানুষের উপকার করা, অন্যের ক্ষতি না করা এবং অপরের সাহায্যে এগিয়ে আসার ব্যাপারে শিক্ষার্থীদেরকে উপদেশ দিতে হবে। নিয়মিত অ্যাসেম্বলিতে কোনো না কোনো নৈতিক বাক্য নিয়ে দুই-তিন মিনিট আলোচনা করতে হবে । প্রাথমিক শিক্ষার পরিবেশ যদি এ রকম নৈতিকতাসমৃদ্ধ হয়,তাহলে আমাদের শিশুরা সফল জীবনোপযোগী ঠিকভাবে বেড়ে উঠবে।

ভালো গুণ ও সদ্ব্যবহার শিক্ষার্থীদেরকে অপরাধ প্রবণতা থেকে দূরে রাখে, তাই প্রতিদিন কমপক্ষে একটি করে ভালো কাজ করার ব্যাপারে তাদেরকে উৎসাহ দিতে হবে এবং নেতিবাচক মানসিকতা ও চিন্তা থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিতে হবে। দুর্নীতি, মাদকাসক্তি, পরীক্ষায় নকল প্রবণতা ইত্যাদি খারাপ কাজে যাতে কেউ জড়িত না হয় সে ব্যাপারে তাদেরকে সচেতন করতে হবে। মন্দ কাজের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে বাস্তব উদাহরণ দিয়ে তাদেরকে বুঝিয়ে সতর্ক করতে হবে।

দিনের বড়ো একটা সময় শিক্ষার্থীরা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সান্নিধ্যে কাটায়, তাই শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ ইচ্ছে করলে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে শিক্ষার্থীদেরকে নৈতিক চরিত্র গঠনে এগিয়ে নিতে পারেন। আগেই বলেছি, শৈশবে শিক্ষার্থীরা যা কিছু শেখে বা দেখে, তা তাদের মনে গভীর রেখাপাত করে এবং সারাজীবন তারা সেটা ধরে রাখে বা ধরে রাখার চেষ্টা করে। শিশুকালকে তুলনা করা হয় কাদামাটির সঙ্গে। কাদামাটি নরম থাকে, তাই সেটি দিয়ে যেকোনো জিনিস গড়া যায়।

বর্তমানে সারাদেশ মূল্যবোধের অবক্ষয়ে ধুঁকছে, নৈতিক শিক্ষার প্রকট অভাবে ভুগছে জাতি। সমাজের ছোটরা আজকাল বড়োদেরকে অতীতের মতো সম্মান করে না, গুরুজনদের দেখে উঠে দাঁড়ায়না ও সালাম দেয়না। পাবলিক বাসগুলোতে যাতায়াতের সময় বয়স্ক গুরুজনদের দেখে এখন আর কমবয়সীরা আসন ছেড়ে দাঁড়ায় না, এমন কি অনেক সময় ছাত্র-ছাত্রী বা তাদের সমবয়স্ক লোক বয়স্ক লোকদেরকে ধাক্কা কিংবা ঠ্যালা দিয়ে বাসের আসন দখল করে বসে। এভাবে নৈতিকতার অবক্ষয় হতে থাকলে সভ্যতা ও সংস্কৃতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা প্রবল উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুদের অন্তরে। তাই প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সকল শিশুর সুপ্ত প্রতিভাকে বিকশিত করার পাশাপাশি তাদের নৈতিকতা ও দেশপ্রেমের বিকাশ ঘটিয়ে প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে তুলতে হবে। প্রকৃত মানুষরাই তো দেশের সুনাগরিক ও জনসম্পদ। প্রাথমিকের গণ্ডিতে শিশুদেরকে সচ্চরিত্রবান ও নৈতিকতাবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পিতা-মাতার পরেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কেবল এরই মাধ্যমে দেশ ও জাতি সব ধরনের অবক্ষয় থেকে মুক্তি পাবে, সর্বক্ষেত্রে নৈতিক মূল্যবোধের মাধ্যমে সুশিক্ষার আলোয় আবারো উদ্ভাসিত হবে
প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ।

 

লেখকঃ

শিক্ষক

চম্পট পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বান্দরবান

সম্পর্কিত পোস্ট

সর্বশেষ পোস্ট



Shares