বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১০ মাঘ ১৪৩১

পাড়া সংগঠন থেকে সশস্ত্র সংগঠন : কারা এই কেএনএফ

প্রকাশ: ৪ এপ্রিল ২০২৪ | ৯:৪৫ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ৪ এপ্রিল ২০২৪ | ৯:৪৫ পূর্বাহ্ণ
পাড়া সংগঠন থেকে সশস্ত্র সংগঠন : কারা এই কেএনএফ

আমিনুল ইসলাম খন্দকার, বিশেষ প্রতিনিধি

পার্বত্য জেলা বান্দরবানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘাতে জড়িয়ে পাহাড়ী পড়া সশস্ত্র সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ দেশবাসীর কাছে এক আতঙ্কের নামে পরিচিত হলেও, গতকাল ও আজ রুমা এবং থানচিতে ৩ টি ব্যাংক প্রকাশ্যে লুট করে ফের আলোচনা কেএনএফ।

কারা এই কেএনএফ?
কেএনএফ এর পুর্নাঙ্গ রুপ কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। ২০১৬ সালে সশস্ত্র গ্রুপটি তৈরি হয়। তবে ২০২২ সালের মে মাস থেকে তাদের কর্মকাণ্ড প্রকাশ্যে আসে। এই  সংগঠনের সশস্ত্র সদস্যের সংখ্যা ৩ থেকে ৪ শতাধিক। তারা সবাই খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী এই সংগঠনের নেতা। তিনি রুমা উপজেলার এডেন পাড়ার অধিবাসী। নাথান লনচেও বম-ই কেএনএফের প্রধান। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ নম্বর আসন বান্দরবান থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোয়নপত্র সংগ্রহ করেছিলেন নাথান বম।

রুমার এডেন পাড়ায় কুকি-চিন ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিও) নামের একটি এনজিও আছে তার।২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণও করেছিলেন তিনি।

জানা যায়,শুরুতেই এর সংগঠনের  নাম ছিলো কুকি-চীন ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার্স। প্রথমদিকে তারা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচী পরিচালনা করে এবং ভারতের মনিপুর ও বার্মার চীন রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে   সম্পর্ক গড়ে তোলে।এই বছরের মে মাস থেকে তদের  সশস্ত্র রুপ প্রকাশ্যে আছে। তাদের সদস্যরা মণিপুর, মিজোরাম ও বার্মায় প্রশিক্ষপ্রাপ্ত।

মূলত সন্তু লারমার জেএসএস থেকে বের হয়ে বম জাতিগোষ্ঠীর কিছু সদস্যকে নিয়ে নাথান বম সশস্ত্র এই সংগঠনটি তৈরি করেন। যে কারণে এটি বম বাহিনী নামেও পরিচিত। তবে কেএনএফ দাবি করছে, রাঙামাটি ও বান্দরবান অঞ্চলের ছয়টি জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে তারা।  সেগুলো হলো বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, ম্রো ও খুমি।  এই ছয়টি জাতি অধ্যুষিত রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি এবং বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদম—এই উপজেলাগুলো নিয়ে  আলাদা রাজ্য গঠন করা হবে।

যদিও বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, স্বায়ত্তশাসনের পাশাপাশি পাহাড়ে চাঁদাবাজিও চোরাকারবারের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে জেএসএসের সাথে মনোমালিন্যের জের ধরে এই সংগঠনটির প্রতিষ্ঠা।এছাড়া বম সম্প্রদায় নিজেদের পার্বত্য চট্টগ্রামের আদি বাসিন্দা বলে  মনে করে।  চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা প্রভৃতি জনগোষ্ঠীকে তারা বার্মিজ, ভারতীয় জাতিভূক্ত এবং বহিরাগত মনে করে।জেএসেসের নেতাদের অধিকাংশ চাকমা ও  মারমা সম্প্রদায়ের। যে কারণে তারা জেএসএস থেকে বের হয়ে আলাদা সংগঠন করেছে। আর  প্রতিষ্ঠার পর থেকেই জেএসসের সাথে সংঘাতে জড়াচ্ছে তারা। এরপর্যন্ত কেএন এফের হাতে এপর্যন্ত জেএসএসের ৩০-৪০  জন কর্মী নিহত হয়। আর আহত হয় অর্ধশাতাধিক। গত বছরের আগস্ট থেকে পাহাড়ে কেএনএফ তৎপরতা শুরু করে। এদের সাথে নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষে এ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর পাঁচ সদস্যসহ ২২ জন নিহত হয়। কেএনফের ১৭ সদস্যকে আটক হয়।

কেএনএফ এর যতো সহিংসতা!
গত বছরের মার্চে বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে সেনাবাহিনীর টহল দলের ওপর কেএনএর অতর্কিত গুলিবর্ষণে সেনাবাহিনীর মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার নাজিম উদ্দিন নিহত হন।

এরপর গত মে মাসে রুমা উপজেলায় অতর্কিত গুলিতে নিহত হন দুজন সৈনিক। আহত হন আরও দুজন অফিসার।

এ ঘটনার পর সেনাবাহিনীর তরফ থেকে বলা হয়েছিলো রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি উপজেলার গহীন অরণ্যে কুকি চিন অরাজক পরিবেশ সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে।
এর আগে গত এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে কুকি চিনের আটজন সদস্য নিহত হয়েছিল। নিহতরা সবাই ছিল বম সম্প্রদায়ের।

তখন নিরাপত্তা বাহিনীর তরফ থেকে বলা হয়েছিল, কুকি চিন এবং এবং ইউপিডিএফ-এর মধ্যে সংঘাতে তারা নিহত হয়।

কেএনএফ এর সন্ত্রাসী তৎপরতার কারণে আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠায় বান্দরবানের রুমা উপজেলা থেকে ১৩২টি পরিবারের ৫৪৮ জন নারী পুরুষ ভারতের মিজোরাম সীমান্তে পাড়ি জমিয়েছে। এদের সবাই পাহাড়ি বম সম্প্রদায়ের লোক।

মঙ্গলবার ২ এপ্রিল বান্দরবানের রুমায় উপজেলা প্রশাসন কমপ্লেক্স ভবনে হামলা চালিয়ে সিনেমা স্টাইলে প্রকাশ্যে সোনালী ব্যাংক লুট করে নিয়ে গেছে একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী দল। এসময় তারা ব্যাংকের ম্যানেজার মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়।

এই ঘটনায় ১৪ ঘন্টা পার হতে না হতে ফের দিনদুপুরে আজ রুমার পর আবার থানচির সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকের শাখায় ডাকাতির ঘটনা ঘটায় কেএনএফ।

কাজে আসেনি শান্তি আলোচনা!
পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও কেএনএফ সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ২০২৩ সালের জুন মাসে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ক্যশৈ হ্লার নেতৃত্বে ১৮ জন সদস্যদের নিয়ে গঠিত হয় শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি। পাহাড়ে বিরাজমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে দুই পক্ষের মধ্যে কয়েকবার ভিডিও কনফারেন্সে বৈঠক হলেও গত ৫ নভেম্বর রুমার মুনলাই পাড়ায় কেএনএফ এর সাথে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম বৈঠকে কেএনএফ চারটি দাবি উপস্থান করে। এবার দ্বিতীয় বৈঠকে চারটিসহ মোট সাতটি বিষয়ে দাবি উপস্থাপন করে কেএনএফ। কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্টে (কেএনএফ) কে সাথে নিয়ে গত মঙ্গলবার (৫ মার্চ) সকাল পৌনে এগারোটা বান্দরবানের রুমা উপজেলার বেথেল পাড়া কমিউনিটি সেন্টারের হল রুমে কেক কেটে দ্বিতীয়বারে মতো সরাসরি বৈঠক করেছিলো শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি।

বৈঠকে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির এবং কেএনএফ উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনা হয়। এ সময় কেএনএফ তাদের কারাবন্দি ২৩ সদস্যকে তিন মাসের মধ্যে মুক্তি; বেসামরিক নাগরিকদের প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসনে সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ; অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা নিশ্চিত করা; শান্তি চুক্তি সম্পাদন না হওয়া পর্যন্ত ভারতের মিজোরামে আশ্রয় নেওয়া পাঁচ শতাধিক বম জনগোষ্ঠীর মানুষকে সরকারিভাবে দেশে ফিরিয়ে না আনাসহ ছয় দফা দাবি উপস্থাপন করে।

প্রশাসন যা বলছে,

কেএনএফ এর ব্যাপারে পুলিশ সুপার সৈকত শাহিন বলেন, ‘চলমান শান্তি প্রক্রিয়ার সংলাপের মধ্যে কেন এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে তা আমরা খতিয়ে দেখছি।

রুমা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাজাহান বলেন, ‘বুধবার ৩ এপ্রিল পর্যন্ত এ বিষয়ে মামলা হয়নি, ব্যাংক ম্যানেজার উদ্ধারে কাজ চলছে, আটক করা হয়নি কাউকে।’

শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির মুখপাত্র ও পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য কাঞ্চন জয় তংচঙ্গ্যা বলেন, ‘এ ঘটনায় শান্তি প্রক্রিয়ায় প্রভাব পড়বে। আমরা এ ঘটনায় স্তম্ভিত ও হতবাক। শান্তির সমঝোতা অমান্য করে তাদের এই ঘটনায় সবকিছু প্রশ্নবিদ্ধ।

জেলা প্রশাসক (ডিসি) শাহ মোজাহিদ উদ্দিন বলেন, ‘এ ঘটনার পর সব সংস্থা একযোগে কাজ করছে। সবকিছু স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছি।

সোনালী ব্যাংকের শাখায় ডাকাতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
বুধবার (৩ এপ্রিল) সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে আইজিপি এই হুঁশিয়ারি দেন।

বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে ৩ ব্যাংকে ডাকাতির ঘটনায় সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) বিরুদ্ধে যৌথ অভিযানে নেমেছে পুলিশ ও বিজিবি। তাদের সঙ্গে যোগ দেবে সেনাবাহিনীও।

বুধবার (৩ এপ্রিল) সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ইদানিংকালে আমরা দেখছি কুকি-চিন আবারও মাথাচাড়া দিচ্ছে। এরই মধ্যে পুলিশ ও বিজিবি অভিযান শুরু করেছে। প্রয়োজন হলে সেনাবাহিনীও অভিযানে যোগ দেবে।

শান্তির পথে ফিরে আসা-না আসাকে কেন্দ্র করে কেএনএফের মধে মতবিরোধ হতে পারে যার ফলে ব্যাংক লুটের এই ঘটনা ঘটে বলে মনে করছে অনেকে।

বর্তমানে ভারতের মিজোরামে অবস্থানরত সংগঠনটির প্রধান নাথান বমের উপদেষ্টা লালএংলিয়ান বম বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। আমরাও এ ঘটনায় হতবাক।

কেএনএফের এই তৎপরতায় বান্দরবানে পর্যটন শিল্পের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। বান্দরবানের কয়েকটি উপজেলায় পর্যটক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞাও দেয়া হয় প্রশাসন থেকে।

আজ কেএনএফ তাদের ফেইসবুক পেইজে জানায়,
কেএনএফ-এর মূল দাবি সরকার মেনে নেওয়াই হল অত্রাঞ্চলের সমস্যার আসল সমাধান। এ পাহাড়-পর্বত আমাদের, এ জঙ্গল আমাদের, আমাদের পূর্ব-পুরুষদের সম্পত্তির রক্ষার দায়িত্ব আমাদের। কেএনএফ-এর দাবি মেনে না নিলে এ পাহাড়ে কোন পর্যটনশিল্প গড়ে উঠতে পারবেনা, হবেনা কোন বনজঙ্গল নিধনের পরিকল্পনাও, বন্ধ হবে রাস্তাঘাট নির্মাণ ও সকল প্রশাসনিক কার্যক্রম।

সম্পর্কিত পোস্ট

সর্বশেষ পোস্ট



Shares